শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
 
vatirrani News

প্রচ্ছদ মুক্তমঞ্চ বাজেট ও পর্যটন শিল্প

বাজেট ও পর্যটন শিল্প

প্রফেসর ড. মোহাম্মদ বদরুজ্জামান ভূঁইয়া (কাঞ্চন) | ৯:২৮ অপরাহ্ন, ১২ জুন, ২০২০

1591975725.jpg
প্রফেসর ড. মোহাম্মদ বদরুজ্জামান ভূঁইয়া (কাঞ্চন)

প্রফেসর ড. মোহাম্মদ বদরুজ্জামান ভূঁইয়া (কাঞ্চন): প্রতিবছরের মত জুন মাসে বাংলাদেশের বাজেট ঘোষণা করেছেন বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রী। ২০২০-২১ অর্থবছরে বাজেটের আকার ৫ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকা। বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৩ হাজার ৬৩৪ কোটি টাকা।

একটি বিশেষ সময়ে ঘোষণা করে হয়েছে এই বাজেট। সারা বিশ্ব এখন করোনা নামক এক প্রাকৃতিক দূর্যোগের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। ফলে বর্তমান সময়টা চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিতে হচ্ছে সরকারকে। এই বাজেটকে বলা হচ্ছে মানুষের টিকে থাকার বাজেট, যেখানে জীবিকা ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সচল রাখার পাশাপাশি মানুষের জীবনের প্রতি দৃষ্টি রাখতে হবে।

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড প্রায় দুই মাস বন্ধ থাকার পর জুনের প্রথমদিন থেকে কিছুটা সচল করার চেষ্টা চলছে। তবে মানুষের জীবনযাত্রা কবে পরিপূর্ণভাবে স্বাভাবিক হবে তা এখনই বলা যাচ্ছে না। এরই মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে পর্যটন শিল্প। যেখানে বিগত কয়েক বছরের ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশের মোট জিডিপির পরিমাণ ছিল গড়ে সাড়ে ৭ থেকে ৮ শতাংশের উপরে, সেখানে বর্তমানে সকল কর্মকাণ্ড ঠিক রেখে বিশ্ব বাজারে টিকে থাকাই মানুষের জন্য মূল চ্যালেঞ্জ।

২০১৯ সালের তুলনায় ২০২০ সালের শুরুটা পর্যটনের জন্য বেশ ভালোই ছিল। বিশ্ব পর্যটন সংস্থার মতে, ২০২০ সালের জানুয়ারি মাসে পর্যটকের সংখ্যা বিগত বছরের তুলনায় ২ শতাংশ বেশি ছিল। তবে করোনাভাইরাসের প্রভাবে ফেব্রুয়ারি মাস থেকে প্রায় পর্যটক শূন্য দেশগুলো। বিশ্বব্যাপী লকডাউন জোরদার হওয়ার সাথে সাথে পর্যটকের সংখ্যাও দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে। জুনের শুরু থকে কিছু দেশ লকডাউন শিথিল করলেও এখন পর্যন্ত পর্যটনে খরা কমেনি। আর বিশ্বে করোনার প্রভাব কতদিন থাকবে তা এখনি সঠিক করে বলা যাচ্ছে না। আর এর প্রভাবে লকডাউন কার্যক্রম কতদিন থাকবে তাও বলা যায় না।

বিশ্ব পর্যটন সংস্থা তিন ধরনের পূর্বাভাস দিয়েছে। যদি জুলাই পর্যন্ত এই অবস্থা চলতে থাকে তবে বিগত বছরের তুলনায় প্রায় ৫৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি কম হবে, সেপ্টেম্বর পর্যন্ত হলে তা ৭০ শতাংশ হবে আর ডিসেম্বর পর্যন্ত হলে তা গিয়ে দাঁড়াবে ৭৮ শতাংশে, যা পর্যটন শিল্পের জন্য এক ভয়াবহ পরিস্থিতি নির্দেশ করছে। একই সাথে এর প্রভাব পড়বে পর্যটনের সাথে সম্পৃক্ত কর্মসংস্থানে। বিভিন্ন রিপোর্টে বলা হয়েছে, এই সময়ে প্রায় ১০০ থেকে ১২০ মিলিয়ন চাকরি ক্ষতির মুখে পড়বে। বাংলাদেশও এইরকম প্রতিকূল অবস্থায় রয়েছে। এই বাস্তবতা সামনে রেখে বাংলাদেশেও ২০২০-২১ সালের বাজেট ঘোষণা করা হয়েছে।

আমরা দেখেছি, বাজেটে বরাবরই অবহেলিত থেকে যায় এই দেশের পর্যটন খাত। ২০১৩-১৪ সালে পর্যটন খাতে বরাদ্দ ছিল ৩০৭ কোটি টাকা, ২০১৪-১৫ সালে ১৫৯ কোটি টাকা, ২০১৫-১৬ সালে ৩৭১ কোটি টাকা, ২০১৬-১৭ সালে ৬৮৬ কোটি টাকা, ২০১৭-১৮ সালে ৬৮৬ কোটি টাকা এবং ২০১৮-১৯ সালে ১ হাজার ৫০৭ কোটি টাকা। আর বিগত বছর ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেটে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের পরিচালক ও উন্নয়ন খাতে বরাদ্দ ছিল ৩ হাজার ৪২৬ কোটি টাকা। এই বছর কিছুটা বরাদ্দ বেড়েছে।

প্রতি বছর বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে এই খাতের জন্য বরাদ্ধ হয়ে আসছে। এই বাজেটে নাম মাত্র পর্যটন জন্য ৫০/৬০ কোটি টাকা বরাদ্ধ পায়, আর বাকি টাকা বরাদ্দ হয় বেসামরিক বিমান পরিবহনের জন্য। ট্যুরিজমের জন্য আলাদা বাজেট এখন সময়ের দাবি। অন্তত বাজেটে বড় ধরনের বরাদ্দ প্রয়োজন এই শিল্পকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনার জন্য।

করোনায় বাংলাদেশের পর্যটনের সাথে সম্পৃক্ত সকল প্রকার ব্যবসা বাণিজ্য বন্ধ রয়েছে। এর ফলে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোকে টিকে থাকতে প্রয়োজন সরকারের বিশেষ প্রণোদনা। তাছাড়া পর্যটনের সাথে জড়িত অনেকের কর্মসংস্থান পড়েছে হুমকির মুখে। আর বিভিন্ন সংস্থার পূর্বাভাস অনুসারে করোনাভাইরাসের প্রভাব থাকবে আরও প্রায় ১ থেকে ২ বছর। ফলে এই লম্বা সময় পর্যটন শিল্পকে টিকে থাকতে হলে সরকারের পক্ষ থেকে সুচিন্তিত পদক্ষেপ দরকার।

সরকার বিভিন্ন শিল্পের জন্য প্রণোদনা ঘোষণা করেছে। সেইখানে পর্যটনের মত বৃহৎ শিল্পটি রয়ে গেছে অবহেলিত হিসেবে। অথচ পর্যটন শিল্পের সাথে জড়িত আছে কয়েক লাখ ক্ষুদ্র, মাঝারি ও বৃহৎ শিল্প। যার মধ্যে বেশির ভাগ শিল্পই আছে ঝুঁকির মুখে। এই সকল শিল্পকে সহায়তা না করা গেলে টিকে থাকতে পারবে না। ফলে তৈরি হবে চরম অনিশ্চয়তা। বেকার হওয়ার ঝুঁকিতে পড়বে লাখ লাখ মানুষ। তাই অন্যান্য শিল্পের মত পর্যটন খাতের জন্য দরকার স্বল্প, মাঝারি ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা।

বাংলাদেশের পর্যটন খাত সব সময় উপেক্ষিত থেকে গেছে। সঠিক পরিকল্পনা ও পর্যাপ্ত বাজেটের অভাব সময় সময় লক্ষ্য করা গেছে। তাই বর্তমান এই বাজেটকে সামনে রেখে পর্যটন খার সংশ্লিষ্টদের আশা ভরসা অনেক।

মানুষের সঞ্চয় কমে গেছে। ফলে জীবন যাত্রার মানও কমে গেছে। তাই মানুষ আগের চেয়ে ভ্রমণ কম করবে। তাছাড়া স্বাস্থ্য ঝুঁকির কথা চিন্তা করে সবাই ভ্রমণ পরিকল্পনা করবে। এই সকল কারণে করোনার প্রভাব ২০২০ সালের মধ্যে শেষ হয়ে গেলেও পর্যটন খাত স্বাভাবিক হতে আরো দুই থেকে তিন বছর সময় লাগতে পারে। তাই এই সংকটময় সময়ে এই শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে হলে প্রয়োজন বিশেষ বরাদ্দ।

জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস সাম্প্রতিক সময়ে বলেছেন, মহামারি কাটিয়ে ওঠার জন্য পর্যটন একটি প্ল্যাটফর্ম হতে পারে। মানুষকে একত্রিত করার মাধ্যমে পর্যটনই পারে সংহতি ও আস্থা বাড়িয়ে তুলতে। জাতিসংঘ বিশ্ব পর্যটন সংস্থা পুনরায় পর্যটন শুরু করার মাধ্যমে টেকসই বিকাশের জন্য ২০৩০-এর এজেন্ডা এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে এবং আমাদের সমাজের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ সদস্যদের সুরক্ষায় এই খাতটির অনন্য ভূমিকা পালন করবে বলে আশা প্রকাশ করেছে।

ধারণা করা হচ্ছে, করোনা পরিস্থিতি কাটিয়ে ওঠার পর গৃহবন্দি মানুষ বের হবে বিশ্ব ভ্রমণে। অনিশ্চয়তা কাটিয়ে উঠে মানুষ নতুন করে বাঁচার আনন্দ উপভোগ করবে। তাই এই সংকটময় সময়ে পর্যটন শিল্পের সাথে সম্পৃক্ত সকলে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। জাতীয় বাজেটে সেই পরিকল্পনার প্রতিফলন দেখতে পেলাম কি?

লেখক : চেয়ারম্যান, ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

Post Your Comment

সম্পাদক: গোলাম রসূল, উপদেষ্টা সম্পাদক: কুদ্দুস আফ্রাদ ও ইব্রাহিম খলিল খোকন, নির্বাহী সম্পাদক: এস. এম. ফরহাদ
বার্তাকক্ষ: 01911214995, E-mail: info@vatirrani.com
Developed by CHAHIDA.COM