মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৪
 
vatirrani News

প্রচ্ছদ মুক্তমঞ্চ হাওরের মাছগুলো খাচ্ছে কারা?

হাওরের মাছগুলো খাচ্ছে কারা?

গোলাম রসূল | ৯:১১ অপরাহ্ন, ২৪ জুন, ২০২৩

1687619543.jpg

গোলাম রসূল: একটা সময় প্রবাদ ছিল মাছে-ভাতে বাঙ্গালী। এখন সেটা হয়েছে ব্রয়লার মুরগি-ভাতে বাঙ্গালী। কারণ মাছের তুলনায় ব্রয়লার মুরগি অনেক সস্তা ও সহজলভ্য। আমাদের অষ্টগ্রামের হাওরের নদী, খাল-বিল, আর পুকুরগুলোতে পর্যাপ্ত পরিমাণ মাছ ছিল একসময়। এখন পরিবেশের বিপর্যয় ও নিষিদ্ধ জালে মা ও পোনা মাছ ধরার কারণে মাছের পরিমাণ অনেক কম। এককালে যে অষ্টগ্রামের মানুষের আমিষের প্রধান উৎস ছিল হাওরের দেশীয় প্রজাতির নানান জাতের সুস্বাদু মাছ, সে অষ্টগ্রামের মানুষ এখন ব্রয়লার মুরগি ও পাঙ্গাস মাছের উপর নির্ভরশীল। আবার যে পরিমাণ মাছ পাওয়া যাচ্ছে তা স্থানীয় বাজারে পাওয়া যায়না। মাঝে-মধ্যে পাওয়া গেলেও সাধারণ মানুষ তা কিনে খেতে পারেন না। সেই মাছ টাকাওয়ালা মানুষ বেশি দামে কিনে নিচ্ছে।

২০১৭ সালের ২০ ডিসেম্বর “মহামান্য রাষ্ট্রপতির কাছে খোলা চিঠি: হাওরের নদীগুলো ইজারামুক্ত করে দিন” শিরোনামে আমি ভাটির রানিতে একটি খোলা চিঠি লিখেছিলাম সদ্য সাবেক মহামান্য রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ মহোদয়ের কাছে। সেখানে আমি লিখেছিলাম--

“শ্রদ্ধেয় প্রিয় মহামান্য রাষ্ট্রপতি,

সেই ছোটবেলা থেকেই আপনাকে দেখে আসছি। আমাদের গ্রামে, সাভিয়ানগর বাজারে আর অষ্টগ্রাম খেলার মাঠে। কখনো সরাসরি কথা হয়নি আপনার সাথে। আমার বাবা বীর মুক্তিযোদ্ধা মনজুরুল হক ভূইয়া আপনি ও বঙ্গবন্ধুর অন্ধ ভক্ত। গোটা উপজেলায় যেকজন নিবেদিত আওয়ামীলীগার আছেন তিনি তার মধ্যে অন্যতম। তিনিই সম্ভবত একমাত্র ব্যক্তি যিনি সারাজীবন আপনার রাজনীতি করেও আপনার কাছে একটি টাকারও সুবিধা নেননি। চাননি দলীয় কোন পদ পদবি। আপনি তা জানেন। কেন জানিনা তিনি আজ পর্যন্ত আমাদেরকে আপনার কাছে নিয়ে যাননি। পরিচয় করিয়ে দেননি।

কিন্তু অবশেষে আমার সে সৌভাগ্য হল। আপনার সাথে পরিচয় হল অষ্টগ্রামে, জেলা পরিষদ ডাকবাংলোয়। রোটারী ডিগ্রী কলেজের রজতজয়ন্তী ছিল সেদিন। কলেজের অধ্যক্ষ ও আপনার আস্থাভাজন মো: মোজতাবা আরিফ খান স্যার আমাকে আপনার কাছে নিয়ে গেলেন। আলাপ করিয়ে দিলেন। আপনি আব্বার খোঁজখবর নিলেন। অনেক স্মৃতিচারণ করলেন। শেষে আমাকে বলেছিলেন আব্বাকে নিয়ে বঙ্গভবনে যেতে। জোর দিয়েই বলেছিলেন। আর সেটি খেয়াল করেছিলেন অষ্টগ্রাম আওয়ামীলীগের মহিলা বিষয়ক সম্পাদক সৈয়দা নাসিমা আক্তার ম্যাডাম। প্রায় এক ঘন্টা পর আপনার কাছ থেকে যখন ফিরি তিনি আমাকে বলেছিলেন, “হামিদ ভাই এত আন্তরিকভাবে কাউকে বঙ্গভবনে যেতে বলছেন সেটা আমার চোখে পড়েনি। তুমি অনেক ভাগ্যবান। যা চাইবে তাই দিবেন আশা করি।”

আমি আজও একা কিংবা আব্বাকে সাথে নিয়ে বঙ্গভবনে যাইনি। তাই হয়নি আমার কোন চাওয়া পূরণ। কিন্তু আজ আমি চাইছি। হাওর এলাকার সমস্ত নদীগুলোকে আপনি ইজারামুক্ত করে দিন। এটা শুধু আমার চাওয়া না। গোটা হাওর এলাকার লাখো মানুষের দীর্ঘদিনের প্রাণের দাবি এটি। আমি বিশ্বাস করি শুধুমাত্র আপনি চাইলেই আমার এ দাবি পূরণ সম্ভব। হাওর এলাকার ব্যাপক উন্নয়ন সাধন করে আপনি ইতিমধ্যে লাখো মানুষের অন্তরে ঠাঁই করে নিয়েছেন। পেয়েছেন ভাটির শার্দুল উপাধি। হাওর এলাকার সমস্ত নদীগুলোকে ইজারামুক্ত করে দিলে ভাটি এলাকার মানুষ সারাজীবন আপনার নিকট কৃতজ্ঞ থাকবে। আপনার নাম লেখা থাকবে স্বর্ণাক্ষরে। আপনি হবেন হাওর ইতিহাসের মহানায়ক।

আজকে আমার খুব মনে পড়ছে ছোটবেলার কথা। বর্ষাকালে ডোড্ডা বিল ও তার আশপাশে মাছ ধরছে আনোয়ারপুর, মনোহরপুর, রথানী ও পাওন গ্রামের শত শত মানুষ। ছোট ছোট ডিঙি ও কোষা নিয়ে মাছ ধরার সে এক অপরুপ দৃশ্য। হঠাৎ দেখতাম এই নৌকাগুলো তীব্র বেগে আমার পাউন গ্রামের দিকে আসছে। একটু পরেই জানা গেল নদীর ইজারাদারের পাহাড়াদাররা তাদেরকে ধাওয়া করেছে। ধরতে পারলে জাল নিয়ে নিবে। সরকার ইজারা দিয়েছে নদী। অথচ জেলেরা নদী তীরবর্তী বিল ও জমিতেও মাছ ধরতে পারত না। একই দৃশ্য হাওরের প্রত্যেকটি এলাকায় বিরাজমান।

অত্যন্ত দু:খজনক হাওরে মাছ ধরার সে অপরুপ দৃশ্য এখন আর দেখা যায়না। কারণ, শোনা যায় জেলেদেরকে পাহাড়াদারারা এখন আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে ধাওয়া করে। আগে জীবন, পরে জীবিকা। তাই হাওরে জেলের সংখ্যা কমে গেছে। কমে গেছে ভাটি এলাকার বাজারগুলোতে মাছের পরিমাণ। হাওরের যে মানুষগুলো খাল, বিল আর নদীর তাজা মাছ খেয়ে প্রকৃতির সাথে সংগ্রাম করে দশকের পর দশক টিকে থেকেছে, সে মানুষগুলো এখন বিদেশী সিলভার কার্প আর পাঙাস মাছের কাছে অসহায়। হাওরের মাছ এখন হাওরের মানুষ খেতে পারে না। খায় টাকাওয়ালা শহুরে মানুষজন। ইজারাদাররা নদীতে মাছের ঘের দিয়ে মাছ ধরে সব মাছ শহরে আর বিদেশে রপ্তানি করছে।

এর ফলে হাওরের অনেক মানুষ বেকার হয়েছে। হাওরের জেলেপাড়ার মানুষরা এখন শহরমুখী। হাওরের মানুষ মাছ কম খেতে খেতে প্রোটিনের অভাবে ভোগছে। মাছে-ভাতে বাঙ্গালি কথাটি এখন আর হাওরের মানুষজন বলতে পারোনা। এ অবস্থা থেকে উত্তরণ প্রয়োজন। আপনি আপনার বিশেষ ক্ষমতা দিয়ে হাওরের নদীগুলো ইজারামুক্ত করে দিন। তাতে হাওরের নদীগুলোতে মাছ ধরার উৎসব হবে। কমবে বেকারত্বের হার। হাওরের গরীব মানুষগুলো পাবে প্রয়োজনীয় প্রোটিন।”

এরপর ২০১৮ সালের ২২ সেপ্টেম্বর আমি আরেকটি কলাম লিখি “রাষ্ট্রপতির অষ্টগ্রামের সংবর্ধণায় জলমহাল ইজারার বিষয়টি তোলা হোক” শিরোনামে।

সেই মতামত কলামে আমি লিখেছিলাম --“আগামি সোমবার (২৪ সেপ্টেম্বর) মহামান্য রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ মহোদয় আমাদের অষ্টগ্রামে আগমন করবেন। দ্বিতীয় মেয়াদে রাষ্ট্রপতি হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার পরে এটা তাঁর প্রথম অষ্টগ্রাম সফর। তাই এ উপলক্ষ্যে অষ্টগ্রামে উনাকে স্বাগতম জানিয়ে একটি গণসংবর্ধণা দেয়ার আয়োজন করা হয়েছে। আমি ঐ অনুষ্ঠানের সফলতা কামনা করি। সাথে সেখানে হাওর এলাকার জলমহালগুলোর ইজারা বন্ধের প্রসঙ্গটি মহামান্য রাষ্ট্রপতির নিকট তুলে ধরার জন্য স্থানীয় প্রশাসন, উপজেলা চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী নেতৃবৃন্দের নিকট আহবান জানাই। জলমহালগুলোর ইজারা বন্ধের বিষয়টি কেন আপনারা তুলে ধরবেন তার স্বপক্ষে আমি মোটাদাগে কয়েকটি যুক্তি উপস্থাপন করলাম।

এক: গত ১৫ সেপ্টেম্বর দেশের প্রভাবশালী দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকায় ‘সরকারি কর্মকর্তাদের পকেটে জলমহাল ইজারার টাকা’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। এতে বলা হয় কিশোরগঞ্জের ১৮টি জলমহাল ইজারার নামে তৎকালীন জেলা প্রশাসক সিদ্দিকুর রহমান, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) নূরে আলম সিদ্দিকী, তৎকালীন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) দেলোয়ার হোসেন, সহকারী রাজস্ব কমিশনার ফজলুল হক, শামীম আল ইমরান ও মাহবুব জামিল গংরা দেড় কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন। ভূমি সচিব আব্দুল জলিল দেড় কোটি টাকা আত্মসাতের বিষয়টির সত্যতা নিশ্চিত করেছেন। অভিযুক্ত অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক নূরে আলম সিদ্দিকীও স্বীকার করেছেন বছরের পর বছর ধরে এসব অনিয়ম হয়ে আসছে। তার মানে কি দাড়ালো? জলমহাল ইজারার অর্থ সরকারি কোষাগারে জমা হচ্ছে না। ইজারার সব টাকা খাচ্ছে রাষ্ট্রের মেধাবী কর্মকর্তা নামধারী কিছু উচ্চপদস্থ চোরের দল। আর তাই যদি হয় তবে হাওরের জলমহালগুলো কেন ইজারা দিবেন?

দুই: যখনই হাওরের জলমহালগুলোর ইজারা বাতিলের দাবি তোলা হয় তখনই স্থানীয় প্রশাসন, রাজনীতিবীদ ও নীতিনির্ধারকগণ বলেন ইজারা না দিলে সরকার রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হবে। বাজেটে ঘাটতি থাকবে। ফলে দেশ পরিচালনায় সমস্যা হবে। আপনারা একদম সঠিক বলেন। তবে সেটা সাদাচোখে। আপনাদের জ্ঞাতার্থে আমি একটি তথ্য দিই। কিশোরগঞ্জের হাওরগুলো ইজারা দিয়ে যে পরিমাণ রাজস্ব আয় হয় তার কয়েকগুণ বেশি অর্থ খরচ করতে হয় নদী খনন কাজে। অর্থাৎ খাজনার চেয়ে বাজনা বেশি। আর নদী খনন করতে হচ্ছে ইজারাদারদের দ্বারা নদীর প্রবাহপথ রোধ করার জন্যই। জলমহালগুলো ইজারা না দিলে হাওরের নদীগুলোর নাব্যতা ঠিক থাকত। আর নাব্যতা ঠিক থাকলে খনন করার প্রয়োজন পড়ত না। আশা করি হিসেবটি খুব সহজেই বুঝতে পেরেছেন।

তিন: অত্যন্ত দু:খজনক হাওরে মাছ ধরার অপরুপ দৃশ্য এখন আর দেখা যায়না। হাওরে জেলের সংখ্যা কমে গেছে। কমে গেছে ভাটি এলাকার বাজারগুলোতে মাছের পরিমাণ। হাওরের যে মানুষগুলো খাল, বিল আর নদীর তাজা মাছ খেয়ে প্রকৃতির সাথে সংগ্রাম করে দশকের পর দশক টিকে থেকেছে, সে মানুষগুলো এখন বিদেশী সিলভার কার্প আর পাঙাস মাছের কাছে অসহায়। হাওরের মাছ এখন হাওরের মানুষ খেতে পারে না। খায় টাকাওয়ালা শহুরে মানুষজন। ইজারাদাররা নদীতে মাছের ঘের দিয়ে মাছ ধরে সব মাছ শহরে আর বিদেশে রপ্তানি করছে।

সুতরাং, আমি আশা করি আমাদের সকল প্রতিনিধিগণ অষ্টগ্রামের সংবর্ধণায় জলমহাল ইজারা বন্ধের বিষয়টি রাষ্ট্রপতির সামনে তুলে ধরবেন এবং মহামান্য রাষ্ট্রপতি উনাদের দাবি মেনে নিয়ে হাওরের জলমহালগুলো বন্ধের ঘোষণা দিবেন।”

দুটি লেখায় আমি আমাদের এলাকার অভিভাবক ও জনপ্রতিনিধিদের কাছে ইজারা বন্ধের আহবান জানিয়েছি। সেটা হয়নি। হবেওনা সেটা বুঝতে পেরেছি। তাই নতুন করে আর জলমহালগুলোর ইজারা বন্ধের দাবি জানাব না। এবার নতুন দাবি। আর সেটা হচ্ছে অষ্টগ্রামের জলমহালগুলো হতে প্রাপ্ত মাছ অষ্ট্রগ্রামের বিভিন্ন বাজারে বিক্রির ব্যবস্থা করা। এতে ইজারাদারদের কোন লস হবে না। উপরন্তু কুলিয়ারচর ও দিঘীরপাড়ের সমান দামে নিজ এলাকায় মাছ বিক্রি করলে তাদের পরিবহন খরচ সাশ্রয় হবে। অন্যদিকে অষ্টগ্রামের মানুষ আবার হাওরের মাছের স্বাদ নিতে পারবে।

এই দাবিটা বাস্তবায়ন করা খুব সহজ ব্যাপার। মাননীয় এমপি রেজওয়ান আহাম্মদ তৌফিক ভাই, স্থানীয় প্রশাসন, উপজেলা চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী নেতৃবৃন্দের নিকট আহবান জানাই এ বিষয়ে দ্রুত পদক্ষেপ নিয়ে অষ্টগ্রামের লাখো মানুষের আক্ষেপ ঘুচানোর।

লেখক: সাংবাদিক ও হাওর উন্নয়নকর্মী।

1 Comments


Warning: Undefined array key "datetime" in /home/vatirrani/public_html/comments.php on line 23
মেহেদী
৬:০০ পূর্বাহ্ন, ১ জানুয়ারী, ১৯৭০
"জাল যার জল তার"আমাদের মহামান্যের কল্যাণে সেটা অষ্টগ্রামে অনেক আগেই বাস্তবায়িত হয়েছে। কিন্তু আমাদের অষ্টগ্রামের নেতারা সেটা মানতে নারাজ,(সকলের জন্য নহে) এবং যাদের জন্য এই আদেশ, তারা খুবই দুর্বল, জেলেরা প্রতিবাদী হওয়ার কোন সুযোগ নেই। প্রিয় গোলাম রসুল, আপনি উত্তম প্রস্তাব দিয়েছেন। তবে, সেটা কখনই বাস্তবায়িত হবে না। কারণ এই নদী এবং খাল বিল দেখিয়ে এক শ্রেণীর মানুষ কুলিয়ারচর এবং দিঘীরপাড়ের মাছের আড়ৎ থেকে লক্ষ লক্ষ টাকা দাদন আনে এই শর্তে যে, সাড়া বছর তাদেরকে মাছ দিতে হবে। তবুও আশায় থাকি গরিব জেলেরা একদিন তাদের অধিকার ফিরিয়ে পাবে। আমাদের প্রজন্ম বেঁচে থাকবে মাছে ভাতে, সেই সাথে বিশেষ দোয়া করি, - গরিবের হক মারা মানুষ গুলোকে আল্লাহ হেদায়েত দান করুন।

Post Your Comment

সম্পাদক: গোলাম রসূল, উপদেষ্টা সম্পাদক: কুদ্দুস আফ্রাদ ও ইব্রাহিম খলিল খোকন, নির্বাহী সম্পাদক: এস. এম. ফরহাদ
বার্তাকক্ষ: 01911214995, E-mail: info@vatirrani.com
Developed by CHAHIDA.COM